সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি ও বিশ্ব সেরা ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব আজ নানা কারনে আজ হুমকির মুখে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, আবাসস্থল নষ্ট, খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরা শিকারীদের তৎপরতা সহ মনুষ্য সৃষ্টি নানা জটিলতায় বিলুপ্ত হতে চলেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনের ডোরাকাটা বাঘ। সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৩৫০ থেকে ৫০০ বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রন বনদস্যু ও জলদস্যুদের হাতে চলে যাওয়ায় তাদের শিকার হয়েছে শতাধিক বাঘ। খাদ্য ও আবাসস্থল সংকটে দু’শতাধিক বাঘ পাড়ি জমিয়েছে সুন্দরবনের ভারতের অংশে। বাঘ সংরক্ষণে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান কার্যত কোনো কাজে আসেনি। দূর্নীতি হয়েছে প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুন্দরবনের উপর নানা হুমকি ও চোরা শিকারীদের কারনে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশর বাঘ। জানাগেছে, ১৯০০ সালের দিকে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজারেরও কম। যার প্রায় অর্ধেক বাঘ রয়েছে ভারতে। সারা বিশ্বে বন উজাড় ও প্রতিনিয়ত চোরা শিকারীদের হাতে বাঘ হত্যার ফলে বর্তমানে প্রাণীটি মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পৃথিবীর মাত্র ১৩ টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশগুলো হচ্ছে, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া। বাঘ সমৃদ্ধ দেশগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠেছে‘টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রি’(টিআরসি)। বাঘ বিলুপ্তি রোধকল্পে এর অধ্যুষিত ও সংরক্ষণ বিষয়ে সহায়তাদানকারী দেশগুলো নিয়ে ১৯৯৪ সালের মার্চে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আর্ন্তজাতিক সংস্থা গ্লোবাল টাইগার ফোরাম’(জিটিএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী বাঘ ও বাঘ সমৃদ্ধ বনাঞ্চলগুলো সংরক্ষণে সহায়তা দান করছে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউ,এস,এইড গ্লোবাল টাইগার ইনশিয়েটিভ (জিটিআই), জিআইজেড প্রভৃতি আন্তোর্জাতিক সংস্থা। টি আর এ এফ আই সি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ১৩টি বাঘ সমৃদ্ধ দেশে ৬৫৪টি বাঘের চামড়া, দেহাবশেষ ও হাড় জব্দ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় ঐ সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৪২৫টি বাঘ মারা গেছে। ২০১০ সালের ২০-২৪ নভেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পির্টার্সবার্গে‘টাইগার সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঘোষণার মূল বিষয়গুলো ছিল আগামী ২০২২ সালে বাঘের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত বনাঞ্চলগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, বাঘের আবাসস্থালকে জীববৈচিত্র সংরক্ষণের মূল আধার হিসেবে চিহ্নিত করে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ, বাঘ সমৃদ্ধ বনাঞ্চলে কোনো শিল্প কারখানা স্থাপন, খনিজ পদার্থ উত্তোলন বা পরিবেশ দূষণের মত কোনো কর্মকান্ড পরিচালনা না করা, বনাঞ্চলের চলমান টহল ব্যবস্থাকে উন্নত করে বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণীর নিধন বন্ধ করা, বাঘ সংরক্ষণে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি। বনের জীব-বৈচিত্র, খাদ্য শৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বাঘ। বনের প্রাকৃতিক বংশ বৃদ্ধি যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য বাঘ তৃণভোজী প্রাণী যেমন, হরিণ, শূকর, বন গরু ইত্যাদি শিকার করে বনের প্রতিবেশ চক্রকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। বাঘ বন রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী এবং তার নির্দ্ধারিত আবাসস্থলে অন্য কোনো বাঘ বা মানুষের পদচারনা সহ্য করেনা। বাঘ একটি বনের জীববৈচিত্রের মাত্রা নিরুপনের নির্দেশক। যে বনের অবস্থা যত ভাল সেখানে বাঘের সংখ্যা ও তত বেশি থাকে। বাঘ কমে যাওয়ার অর্থ বনাঞ্চলের অবস্থা বা বাঘের আবাসস্থল বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখিন। তাই বাঘ সংরক্ষণ কেবল মাত্র একক প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নয় এর সঙ্গে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের বসবাস, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রজনন নিয়ন্ত্রন করা। আর এ কারনেই মূলত মহাবিপদাপন্ন প্রজাপতির বাঘ রক্ষায় বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বোচ্ছার হয়ে উঠেছে। ২০০৪ সালে ইউএনডিপি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাঘের পদ (পা) চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। সেই জরিপে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এর মধ্যে পুরুষ বাঘ ১২১টি, মা বাঘিনী ২৯৮ টি ও বাচ্চা ২১ টি ছিল। পরিবেশবিদদের মতে ১৯৭৫ সালের পর সুন্দরবনে আর বাঘ বাড়েনি। বন বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এক দশকে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে ২৪টি ও পূর্ব বিভাগে ১২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সবচেয়ে বেশী ১৪টি বাঘ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছে। খুলনায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসেব অনুযায়ী ২০০২ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে সুন্দরবনে ১২০টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী ১৯৮১-২০০৪ পর্যন্ত ৫৩টি বাঘ হত্যার শিকার হয়। ১৯৮১, ৮২, ৮৪, ৮৫, ৮৭ ও ১৯৯৫ সালে কোনো বাঘ মৃত্যুর শিকার হয়নি। ১৯৮৩ সারে ৩টি, ১৯৮৬ সালে ২টি, ১৯৮৮ সালে ১টি, ১৯৯০ সালে ২টি, ১৯৯১ সালে ৪টি, ১৯৯২ সালে ১টি, ১৯৯৩ সালে ৪টি ১৯৯৪ সালে ২টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ২টি, ৯৯ সালে ৪টি, ২০০০ সালে ৫টি, ২০০১ সালে ১টি, ২০০২ সালে ৩টি, ২০০৪’সালে ৪টি, ২০০৫ সালে ৬টি, ২০০৭ সালে ৪টি, ২০১১ সালে ৪টি ও ২০১২ সালে ১টি বাঘ প্রাণ হারায়। স্থানীয়রা এর পেছনে ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে যার মধ্যে পাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস), লবনাক্ততা বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট, আবাস ধ্বংস ও চোরা শিকারিদের অপতৎপরতা। তবে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও চোরা শিকারিদের হাতে নিহত বাঘের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই কারো। ২০১২ সালের ১১জুন ঢাকার শ্যামলীর একটি বাড়ি থেকে র‌্যাব ৩টি বাঘের শাবক উদ্ধার করে। সূত্র জানায়, ঐ বছর জুনের প্রথম দিকে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা এলাকা থেকে বাঘ পাচারকারী চক্র শাবক ৩টি তাদের মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে প্রথমে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের এক ব্যক্তির মুরগীর ঘরে নিয়ে রাখে এরপর সেখান থেকে পাচার করা হয় ঢাকায়। এছাড়া কৈখালী ফরেস্ট অফিসের বন কর্মকর্তারা কৈখালী নদীর চর থেকে একটি মৃত বাঘ উদ্ধার করে। যার দাঁত, চামড়া, নখসহ বিভিন্ন অঙ্গ পাওয়া যায়নি। বনবিভাগ ও এলাকাবাসী জনায়, ১৯৯৮ সালের ২৬ মার্চ শ্যামনগরের দাতনিখালী গ্রামে একটি বাঘ ঢুকে পড়লে এলাকাবাসী বাঘটিকে গুলি করে হত্যা করে। এর একদিন পর একই এলাকায় আরো একটি বাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়। ২০০৮ সালের ২০ জুন সন্ধ্যায় শ্যামনগরের দক্ষিণ কদম তলা গ্রামে একটি বাঘ প্রবেশ করে। এসময় তার আক্রমনে ১ গৃহবধূসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো ২জন। এ ঘটনার পরের দিন এলাকাবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২০০৯ সালের ২জুন সুন্দরবনের চুনা নদী পার হয়ে শ্যামনগরের খলিশাবুনিয়া গ্রামের কালীবাড়ী নামক স্থানে একটি বাঘ ঢুকে পড়ে। এতে ৩জন আহত হয়। ঘটনার প্রায় ১০ ঘন্টা পর গ্রামবাসী গলায় ফাঁস দিয়ে বাঘটিকে হত্যা করে। ২০১০ সালের জানুয়ারীতে একটি বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করে চন্ডিপুর গ্রামের খোরশেদ আলীর রান্না ঘরের চালের উপর অবস্থান নেয়। গ্রামবাসী বাঘটিকে ঘেরাও করে বনবিভাগ ও পুলিশের খবর দেয়। ১২ঘন্টা পর বনবিভাগ কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২০১১ সালের ২৫ মার্চ শ্যামনগরের ভোলাখালী গ্রামে জনতায় গনপিটুনিতে মারা যায়। ২০১৩ সালের ২১ জুলাই কৈখালী এলাকায় এলাকাবাসী আরো একটি বাঘকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। প্রতি বছর শীত মৌসুমে বাঘের আনাগোনা দেখা গেলেও এবার আর দেখা যায়নি। অথবা দীর্ঘ দিন হল মানুষের উপর বাঘের আক্রমন বা লোকালয়ে বাঘের অনুপ্রবেশর খবর পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে সুন্দরবন থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হতে চলেছে। নানা প্রতিকূলতায় অনেক বাঘ পাড়ি জমিয়েছে ভারতের অংশে। প্রসঙ্গত, পশ্চিম সুন্দরবনের মীরগাং, পার্শ্বেখালী, মুন্সিগঞ্জ, হরিনগরের কাঠ পাচারকারী চক্র প্রতিনিয়ত টেংরাখালী ও মীরগাং ফরেস্ট কর্মকর্তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে কাঠ পাচার করছে। কয়রা থেকে বনদস্যুরা জেলে সেজে কদমতলা অফিস থেকে পাশ পারমিট নিয়ে বনদস্যুদের অস্ত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করছে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে সর্বশেষ বাঘ শুমারী। গত বছর সেপ্টেম্বরে সুন্দরবনে ৬০ টি ইনফ্লারেড ক্যামেরা ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ শুমারীর আয়োজন করলেও তা শেষ পর্যন্ত থমকে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তারা ভাটির সময় ছোট ছোট শাখা খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন করছে। ইতোপূর্বে সংঘবদ্ধ চক্রটি খুলনা রেঞ্জের নীলকোমল এলাকায় বিষ প্রয়োগ ও ফাঁসীতে হরিণ মারা সহ বনদস্যুদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার দায়ে তাদের খুলনা রেঞ্জ থেকে বিতাড়িত করা হয়। সুন্দরবনের বাঘের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আন্তর্জাতিক বাঘ শিকারী সিন্ডিকেটের। কয়েক বছর ধরে চক্রটি সুন্দরবনে বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে ও গুলি করে বাঘ শিকার করে তার চামড়া, মাথা ও হাড়-গোড় পাচার করে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বর্তমানে শতাধিক বাঘও নেই বলে স্থানীদের ভাষ্য। সরকার সুন্দরবন সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য বনে সব ধরণের সম্পাদ আহরণ নিষিদ্ধ’র পরিকল্পনা এমনকি সুন্দরবন সংরক্ষণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রশিক্ষিত ‘গাইড’ ছাড়া সুন্দরবন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তবে তা বাঘ রক্ষায় কতটা কার্যকর হবে তাই এখন দেখার বিষয়। প্রতি বছর ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে এবছর ঐ দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর থাকায় জাতীয় ভাবে ঘটাকরে পালন করা হয়নি আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংগঠন পালন করেনি বাঘ দিবস। বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয় থেকে ৭ আগস্ট বাঘ দিবস পালনের কথা জানানো হয়েছে।

SHARE THIS

0 মন্তব্য(গুলি):