আসছে বৈশাখ, চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার মহাযজ্ঞ

চৈত্রের প্রখর রোদের নিচে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন, যেন শরীরটাই ঝলসে যাচ্ছে! তপ্ত রোদের তেজে যেন ঝলসে ওঠছে পিচ ঢালা পথ। হঠাৎ করেই উড়ে এসে জুড়ে বসা দমকা হাওয়ায় উড়ছে ধুলোবালি। কোথা থেকে নীলাকাশে ভেসে আসে মেঘের ভেলা। আর বিদ্যুতের আচমকা ডাক-চিৎকারে ভিজে যায় বাংলাদেশ! বাংলার এমন প্রাকৃতিক চিত্রই বলছে, বৈশাখের বেশি দেরি নেই। আসছে বৈশাখ শত ব্যস্ততার এই নগরেও। বৈশাখ যতটাই এগিয়ে আসছে আর ততোটাই বস্ততা বাড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের।
বৈশাখকে বরণ করে নিতে প্রতিবছর চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকেই বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। আর এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফলের প্রস্তুতি নিতেই চারুকলায় এখন চলছে মহাযজ্ঞ। নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করতে। চারুকলার ফটকে পা রাখলেই মঙ্গল শোভাযাত্রার কর্মযজ্ঞ চোখে পড়বে।
চারুকলা প্রাঙ্গণে এখন চলছে উৎসব উৎসব রব। এখানে কেউ জলরঙে ছবি আঁকছেন, কেউ সরায় ফুটিয়ে তুলছেন বাহারি দৃশ্য, আবার কেউ মুখোশ তৈরি করছেন। কেউ কেউ এসব সাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা এসব শিল্পকর্ম বিক্রির কাজ করছেন কেউ কেউ। শোভাযাত্রাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে প্রতিবছরের মতো এবারও থাকছে রাজা-রানির মুখোশ, বানর, পাখিসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর লোকজ অবকাঠামো।
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় একটি বৃহৎ হাঁসকে প্রাধান্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ। তবে হাঁসকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও বরাবরের মতো বাংলা সংস্কৃতির সব কিছুই থাকছে এবারের আয়োজনে। সরাচিত্র, খেলনা, পুতুল, মা ও শিশু, বাঘ, হরিণ, মাছ, মাছের ঝাঁক, মুখোশ, হাত পাখা, শখের হাঁড়ি, বিড়াল, লক্ষ্মী পেঁচাসহ আরও নানা ধরনের শিল্পকর্ম থাকছে। সারা বিশ্বের বাঙালির কাছে হাজার হাজার বছরের পুরনো গৌরবোজ্জল বাংলা সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রত্যয়ে প্রতিদিন চারুকলার শিক্ষার্থীরা এখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন।
বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করতে আয়োজকদের বেশ খরচ হয়। অর্থসংস্থানের জন্য চারুকলায় এখন উন্মুক্ত শিল্পকর্ম প্রদর্শনী চলছে। প্রাঙ্গণে আঁকা হচ্ছে ছবি। রঙিন হয়ে উঠছে সরা, যাতে চিত্রিত হচ্ছে বাংলার লোকজ মোটিভ। এসব শিল্পকর্ম ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে দেয়ালে। নবীন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেয়ালে উপস্থাপিত হয়েছে চারুকলার প্রবীণ শিক্ষার্থীদের কাজও। রয়েছে শিক্ষকদের শিল্পকর্মও।
বিক্রি করার জন্য শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে পাখির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা, সরার দাম ২০০ থেকে ১,০০০ টাকা, জল রঙে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্মের দাম ধরা হয়েছে ৩,০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা এবং বিভিন্ন মুখোশের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা থেকে ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া হাত পাখা, বিভিন্ন শো-পিসও বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। যার দাম ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
মাটির সরাকে রঙিন করে তুলছিলেন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তানিয়া। তিনি বলেন, ‘চারুকলার নানা আয়োজনের বড় আয়োজন এই বৈশাখের মঙ্গলশোভাযাত্রা। প্রতি বছর চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। বাঙালির ঐতিহ্য এই শোভাযাত্রার কাজ করতে পেরে গর্বিত বোধ করি। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রতি বছর মঙ্গলশোভাযাত্রার কাজ করি।’
রাজা-রানির মুখোশ তৈরি করতে যে পেপার ম্যাশ প্রয়োজন, তাই বানাচ্ছিলেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। মাটি দিয়ে এই পেপার ম্যাশ তৈরি করতে হয়। রাজা-রানির মুখোশ মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈচিত্রময় করে তোলে।
বৈশাখ আসার আগেই চারুকলা অনুষদের সামনের দেয়ালের বাইরের দিকটাও সাজবে নতুন সাজে। আবহমান বাংলার দৃশ্য ফুটে উঠবে তাতে। চারুকলা অনুষদের সাজ সাজ রব জানান দিচ্ছে, খুব দূরে নয় বৈশাখ।
গাছে গাছে আমের মুকুল, কোকিলের কুহুতান আর গাছের নতুন কচি পাতায় ঋতুরাজ বসন্ত বিদায় নিবে আর মাত্র কয়েক দিন। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনের অপেক্ষায় এখন দিন গুণছে বাঙালিরা। বৈশাখও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবাইকে। বৈশাখের প্রথম দিনে নগরজুড়ে থাকে উৎসবের জোয়ার।

SHARE THIS

0 মন্তব্য(গুলি):