ঘরে বসেই ই-সেবা, তথ্য কেন্দ্রে ভিড় ॥ দারুণ খুশি কৃষক

পঞ্চগড়ে ডিজিটাল কার্যক্রমে ব্যাপক গাড়া
এ রহমান মুকুল
দুই হাজার একুশ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চলমান ডিজিটাল কর্মসূচী পঞ্চগড় জেলায় পুরোদমে চলছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় দ্রুত সরকারী সেবা পৌঁছে দেয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে জেলার ৪৩ ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পাসপোর্ট, বিদেশ গমন ও মানবাধিকার বিষয়ক তথ্য, সরকারী ই-সেবা এবং জেলা প্রশাসক অফিস থেকে ন্যাশনাল ই সার্ভিস সিস্টেম (নেস) পেপারলেস সেবা দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল কার্যক্রম শুরু হওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে অতি সহজে গ্রামের সাধারণ মানুষ বাড়িতে বসে সরকারী নানা সেবা পাচ্ছেন। এসব সেবা পেতে কোন হয়রানির শিকার বা দালালদের শরণাপন্ন এবং অতিরিক্ত কোন টাকাও খরচ করতে হচ্ছে না। ফলে সরকারী নানা সেবা পেতে গ্রামের মানুষ প্রতিদিন ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে ভিড় করছে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক অফিসের প্রত্যেকটি বিভাগ ন্যাশনাল ই সার্ভিসের আওতায় আসায় কর্মকর্তাদের টেবিলে আগের মতো আর ফাইলের স্তূপ জমে থাকছে না। যে কোন বিষয়ের ফাইলে তাৎক্ষণিক মতামত দিয়ে বা স্বাক্ষর করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এতদিন যে কাজটি করতে ৩ থেকে ৭ দিন কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫ দিন লাগত সেই কাজটি এখন এক দিনেই শেষ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক বা কোন কর্মকর্তা অফিসের বাইরে থাকলেও তিনি অনলাইনে জনগুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখে নিচ্ছেন এবং মতামত দিয়ে তাৎক্ষণিক অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছে প্রেরণ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এবং ইউএনডিপির সহযোগিতায় এ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত ডিজিটাল কার্যক্রম ইতোমধ্যে পঞ্চগড়ের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে দেয়ায় অতি দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে পঞ্চগড়ের চিত্র। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে পঞ্চগড় জেলা তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের শেষ প্রান্তে। বর্তমানে জেলা প্রশাসক অফিসের সকল সেক্টরে ডিজিটাল কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কম্পিউটার ল্যাব ও ই-সেবা কেন্দ্র এবং জেলা আইসিটি কেন্দ্র ছাড়াও একটি সার্ভার স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে, যা সরাসরি জাতীয় সার্ভার স্টেশনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ডিজিটাল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসক অফিসের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে দৈনন্দিন জনগুরুত্ব সম্পন্ন কার্যক্রম প্রদর্শন ছাড়াও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পঞ্চগড় জেলা দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রথমস্থান অধিকার করেছে। এ ছাড়াও প্রতিবছর ৩ দিনব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা আয়োজনের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে অবহিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষক তার ফসলের ক্ষেত পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষায় কৃষি কর্মকর্তার কাছে ধরনা না দিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে অতি সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য পাচ্ছেন। জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার একজন কৃষক বাড়িতে বসে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে আখ সরবরাহের পুঁজি পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু জমির কম্পিউটারাইজট খতিয়ানের জবেদা নকল আর আখের পুঁজিই নয়, জেলার প্রত্যন্ত এলাকার সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন হাতের কাছেই তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য এবং সরকারী সেবাসমূহ পাচ্ছেন।
প্রত্যন্ত গ্রামের অশিক্ষিত একজন কৃষকও জানে কিভাবে এবং কোথায় গেলে ফরম, জমির পর্চা, খতিয়ানের জাবেদা নকল, জমির নক্সা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম, অল্প খরচে বিদেশে কথা বলা, কৃষি তথ্যসেবাসহ সরকারী নানা সেবা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান কুদরত-ই-খুদা মিলন জানালেন, আগে জমির খতিয়ানের জবেদা নকল পেতে ১৫ থেকে ২০ দিন আবারও কোন কোন ক্ষেত্রে এক মাসেরও বেশি সময় লাগত। অথচ সেই জবেদা নকল উঠাতে ৩ থেকে ৫ দিনের বেশি সময় লাগছে না। তাও আবার বাড়িতে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। দেবীগঞ্জ উপজেলার মধ্য শিকারপুর গ্রামের কৃষক হাফিজুর গম ক্ষেত পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে শালডাঙ্গা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তার কাছে কীটনাশক ব্যবস্থাপনায় তথ্য পাওয়ায় সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়ায় পোকার আক্রমণ থেকে গম ক্ষেতকে রক্ষা করতে পেরেছেন। বাড়ির কাছে চিলাহাটী ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি, জমিতে চারা রোপণ, সেচ, পরিচর্যাসহ সার-কীটনাশক প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যসেবা পাওয়ায় ভাউলাগঞ্জের অনেক কৃষকই এবার ব্যাপক জমিতে বোরো রোপণ করেন। সঠিক সময়ে বোরো ক্ষেতের পরিচর্যা করায় বাম্পার ফলনেরও আশা করছেন তারা।
সরকারী কোন অর্থ সাহায্য ছাড়াই স্থানীয় সম্পদ এবং উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট মডেম এবং যেসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সরবরাহ করে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও বেকার শিক্ষিত যুবক-যুবতী ও তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনতে তাদের নিয়মিত বিনামূল্যে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট চালানোর ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান চলমান রয়েছে। আর এই প্রশিক্ষণের ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীও জানে কিভাবে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে হয়। আটোয়ারী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম বর্ষালুপাড়ার কলেজছাত্রী সবিতা রানী ছুটির দিনগুলোতে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে এবং সামাজিক ওয়েব সাইট ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে বেশ ভালই অবসর সময় কাটাচ্ছেন। তেলিপাড়া গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবক ডালিম বেশ স্বাবলম্বী। ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের ওপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এখন ধুলাঝাড়ি বাজারে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছেন। এলাকার বেকার যুবকদের কম্পিউটার, ইন্টারনেটের ওপর প্রশিক্ষণ ছাড়াও কৃষকদের চাষাবাদসহ বিভিন্ন রোগবালাইয়ের হাত থেকে ফসলকে রক্ষায় পরামর্শ প্রদান করে আসার পাশাপাশি গ্রামে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিনোদনমূলক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করে সচ্ছলভাবে সংসার চালাচ্ছেন।

SHARE THIS

0 মন্তব্য(গুলি):